তখন রাত ঘন হয়েছে। রহিমের খাওয়া সারাও হয়েছে। চারটে শক্ত পুড়ে যাওয়া রুটি সাথে পাতলা ডাল। জেলে রাত কাটানোর অভ্যাস ওর আছে বেশ কয়েকবার। আবার জেলেই ফিরতে হবে-এ হেন বিশ্বাসেই জন্মেছে সে অভ্যাস।তবে আজকের আর একরাতের জেলটাই তার জন্য শেষবার!তাই কিছু ভালো-মন্দের আর্জি জানিয়েছিল মন। একান্ত না পেয়ে অভিমানে ফেলে গেছে রুটিগুলো। কিন্তু এ অভিমানের দাম এ পৃথিবীর বুকে আর কোথাও যে নেই- দারোয়ান এসে রুটি সমেত থালা ফেরত নিয়ে চলে যায়, কিছু জিজ্ঞাসাও করে না। রহিমের চোখ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঝাপসা হয়ে ওঠ। ৬*৮ ফুটের সেলটায় তার সম্বল একখান খাটিয়া, আর সেরাতের সঙ্গী একদল এলোমেলো ছাড়পোকা। সেই খাটিয়াতেই বসে পরে রহিম, উত্তরের দেওয়ালের উপরটায় একখান খুপরি গ্রীল দেওয়া। খুব হাওয়া আসে। এই ঘন রাতে চাঁদের আলো এমন ভাবে গ্রীল ছুঁয়ে সেলে এসে রহিমের পা-এ ধরা দেয় যেন স্বর্গে যাবার সিঁড়ি! হ্যাঁ, স্বর্গ। অবাক হওয়ার মতোই। জেলখানায় যে থাকে সে আবার স্বর্গে যায় নাকি!

.

খাটিয়ায় বসে রহিম জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে।আকাশে কত তারা, কত অবয়ব আঁকা। কোথাও তারাদের ঢেকে দিয়েছে মেঘ। দেখা যায়না, তবু তারাও আলো দেয়, তারাও আছে সেখানে।রহিমের চোখগুলো কেমন মায়াভরা। মনে মনে বলে ওঠে- "আমিই মালিককে খুন করেছি রেবা, আমি মানি। কিন্তু কারণটা সত্যি করে তোলার সামর্থ্য যে নেই!" মাথা নিচু হয়ে যায় রহিমের, টসটস করে এক ফোঁটা দু-ফোঁটা জল নিষ্প্রাণ সেলের মেঝে ভেজায় চাঁদের জ্যোৎস্নায়। এ চোখের জলের কথা না জানে উকিল না জানে জজ না জানে মালিকের আত্মা আর না জানে বিবি রেবা।

.

রহিম আর রেবার বিয়ে হয়েছে এক বছর। এখনও নিঃসন্তান। অন্তিম শুনানির দিন ফাঁসির আদেশ শুনে রেবা খুব কাঁদছিলো। রহিমের তা দেখে বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো!..দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার অকস্মাৎ ভস্ম হয়ে যাওয়া জীবনটায় আবার দাঁড়াতে চাইছিলো রহিম, তবু নিরুপায়, শিকল ভয়ানক! রেবার কান্না দেখে রহিম তখন বোঝেনি তা স্বামী হারানোর নাকি ঘৃণার!...জেলে দু মাস কাটানোর সময় একবারও রেবার ছায়াটুকুও দেখতে পায়নি সে। মাঝে রেবার আব্বাজান কেবল রহিমকে কটা লোহার আংটি ফেরত দিয়ে গেছিলো, রহিমেরই দেওয়া সাদিতে। সেবার রহিম বুঝেছিলো কান্নাটা, ঘৃণার ছিলো!তারপর আর কোনো পিছুটান নেই ওর।

.

কেবল অর্থের অভাবে নিজের জন্য উকিল ডাকতে পারেনি রহিম। কারখানার মালিক খুনের দায় তাই তার নিয়তি করে দিয়ে গেছে শহুরে কুটিল জাঁতাকল। এক্স ফ্যাক্টর সেই অর্থের কাছে সত্যের বিক্রি হয়ে যাওয়া। কিন্তু রহিম যে আকাশের চাঁদকে সাক্ষী রেখে মনের সত্যি বলে চলে!..প্রমাণ নেই, তাই দাম নেই তার। তাও দাম দিয়ে যেতে হবে নিরপরাধ প্রাণের বিনিময়ে! পরিহাস!!

.

"আকাশে যে তারাগুলো মুখ লুকিয়েছে, কিন্তু আছে - তা যেমন সবাই বোঝে তবে আমায় বুঝলো না কেন??"...রহিম কাঁপা গলায় সেই আকাশকেই প্রশ্ন করে। সেও নিরুত্তর, সবার মতো।

.

(আকাশের দিকে তাকিয়েই খাটিয়ায় শুয়ে পরে রহিম। ছারপোকা আজ কোন ছাড়। রাত গড়িয়ে যায়। চাঁদের জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে আসে)

এক লহমায় হঠাৎ জেগে ওঠে রহিম। মিঠে হাওয়াতেও চপচপে ঘামে ভেজা কয়েদির পোষাক। মুখে শঙ্কা তীব্র!! আতঙ্ক ও!..সে জানতে পারে স্বপ্ন ছিল সেটা, সেই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে একমাত্র মৃত্যুর কাছে আসার স্বপ্ন! শেষ রাতের স্বপ্ন! রহিম ভেবে পায়না স্বপ্নও এতখানি সত্যি হতে পারে!..চিৎকার করতে যায়, ভয়ে আওয়াজ থেমে থেমে আসে। ছটপট করে খাটিয়ে থেকে নেমে এদিক ওদিক ছুটটে যায়- হাত-পা এর শেকল গিলে নেয় সব মুক্তির স্বাদ! আবার ঘুম ভেঙে কাঁদতে বসে পরে রহিম, তবে এবার তা নিঃসঙ্কোচে, উন্মাদ হয়ে!

.

" আমি মরতে চাইনা এভাবে!!!!আমাকে বাঁচাও!!!..আমি সংসার করতে চাই!!আমি কারখানা যেতে চাই!!!আমাকে মেরো না এভাবে!! আমি খুন করিনি, আমি খুন করিনি!! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!! আমি মরতে চাই না!! কেউ বাঁচাও আমাকে!!"....পাগল কুকুরের মতো করে রহিম। কিংবা মানুষের মতোও বলা যায়। আমরা যারা প্রতিবার অন্যায়ভাবে অনেক স্বপ্নকে বন্দী করে দিই বাক্সে!তারপর ফেলে দিয়ে আসি কোনো সমাজ নামক ডাস্টবিনে!!হয়তো স্বপ্নের শব্দগুলো রহিমের মতোই হয়, তাই না!

.

(জীবনের শেষ রাতেও কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পরে খাটিয়ার নীচে রহিম)

পরদিন সকাল হয়।

-কিরে হারামজাদা!!..অনেক তো খাবার নষ্ট করেছিস এখানে পচে পচে, যা আজকে তোর মুক্তি!!(হাসি)

দারোয়ানের লাঠির আঘাতে চোখ খোলে রহিমের। 'মুক্তি' শব্দটা ঘুমের ঘোর আর লাঠির আঘাতের মধ্যেও প্রিয় লাগে রহিমের, বেশ একটা আরাম আছে 'মুক্তি' শব্দটার মধ্যে!

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় রহিম।  সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই কনস্টেবল।

একজন ভেতরে এসে শেকল খোলে একটার পর একটা। রহিম একমনে বাঁধন ভাঙা দেখে, হাত-পা- গা চাড়িয়ে দেয়।

শেকল খোলা শেষ হলে সেলের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে রহিম। দুদিকে দুজন কনস্টেবল আর দারোয়ানের নাগপাশে এগিয়ে যায়। অন্যান্য কয়েদির মুখে এক অদ্ভূত করুণতা জাগানো হাসি দেখে রহিম চিৎকার করে বলে ওঠে-

"শেকলহীন এই আমি, অবশেষে মুক্তির পথে।

সত্য ঘুমিয়েছে পৃথিবীর, আবার দেখা হবে

ঈশ্বরের জন্নতে!"